শেয়ারবাজারে সুশাসনের পথে বড় পদক্ষেপ: আসছে বিএসইসি আইন, ২০২৫
- আপলোড সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০১:২১:৩৬ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০১-০৮-২০২৫ ০১:২১:৩৬ অপরাহ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরেই নানা ধরনের অভিযোগে জর্জরিত—কারসাজি, স্বচ্ছতার ঘাটতি, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা—এসব যেন একটি চক্রাকারে ঘুরপাক খাওয়া বাস্তবতা। বিনিয়োগকারীদের আস্থা হরণকারী এই পরিস্থিতি বদলাতে এবার বড় ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছে সরকার। প্রণয়ন করা হয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইন, ২০২৫–এর খসড়া, যাতে রয়েছে যুগোপযোগী ও কাঠামোগত পরিবর্তনের ছাপ।
এই খসড়া আইনে এমন কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজারে আস্থার নবজাগরণ ঘটতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
শেয়ার কারসাজি: এবার শাস্তি হবে দ্বিগুণ
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ‘অদৃশ্য হাত’ দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগকারীদের জন্য আতঙ্কের নাম। কেউ কেউ বিশেষ সুবিধাভোগী হয়ে একতরফাভাবে বাজার প্রভাবিত করে, আবার কেউ অসদুপায়ে অন্যকে প্রলুব্ধ করে শেয়ারে বিনিয়োগ করায়। নতুন আইনে এই ধরনের কারসাজিকে ধরা হচ্ছে গুরুতর অপরাধ হিসেবে।
বর্তমানে এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা। খসড়ায় প্রস্তাব করা হয়েছে—এটি দ্বিগুণ করে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার। অর্থাৎ, শেয়ারবাজারকে অপব্যবহার করলে তার ফল হবে আগের চেয়ে অনেক কঠোর।
নিয়োগ পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার ছোঁয়া: থাকছে স্বাধীন কমিটি
বিএসইসির নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে এক বড় পরিবর্তন আসছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। এতদিন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ হতো সরাসরি সরকারের হাত ধরে। এবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে—এই নিয়োগ হবে একটি স্বাধীন বাছাই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী।
কমিটি প্রতিটি পদের জন্য দুজন প্রার্থী বাছাই করে সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে। এরপর সরকার তাদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ দেবে। এর ফলে নিয়োগে যেমন স্বচ্ছতা আসবে, তেমনি বিএসইসির কর্মকাণ্ডেও বাড়বে নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতা।
চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের মর্যাদা, বেতন ও সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সমপর্যায়ে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য: আইনের প্রয়োগই হবে চাবিকাঠি
শুধু আইন করলে হবে না—তাকে বাস্তবায়ন করাই হবে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। এমন মত দিচ্ছেন দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এবং আইসিবির বোর্ড চেয়ারম্যান ড. আবু আহমেদ বলেন,
“কারসাজিকারীরা আইনের ফাঁকফোকর ভালো জানে। শুধু কঠোর শাস্তি দিয়ে তাদের থামানো যাবে না। আমাদের দরকার শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ কাঠামোয় গভীর সংস্কার।”
তিনি আরও বলেন,
“বিনিয়োগে মার্জিন লোন সীমিত করতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা নিজস্ব টাকায় বাজারে অংশগ্রহণ করে। দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বাতিল করা উচিত। পাশাপাশি ভালো মিউচুয়াল ফান্ডকে উৎসাহ দিতে কমিশন সুবিধা বাড়াতে হবে।”
আস্থা ফিরবে তো?
প্রশ্ন এখন একটাই—এই আইনের বাস্তবায়ন কি আদৌ সম্ভব হবে? সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, খসড়ায় যে ধরনের প্রগতিশীল প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে বিএসইসির স্বাধীনতা বাড়বে, রাজনৈতিক প্রভাব কমবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে—বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফিরে আসবে।
তবে বাস্তবতা বলছে, কেবল আইন কঠোর করলেই চলবে না—প্রয়োগে থাকতে হবে দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা। এই আইনের সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ—সুশাসনের আলোর পথে, নাকি পুরনো অন্ধকারেই বন্দী।
সচরাচর প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন: বিএসইসি আইন ২০২৫–এ শেয়ার কারসাজির শাস্তি কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে?
উত্তর: নতুন খসড়া আইনে শেয়ার কারসাজির সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর এবং জরিমানা ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কীভাবে নিয়োগ পাবেন?
উত্তর: স্বাধীন বাছাই কমিটি প্রতিটি পদে দুজন প্রার্থী সুপারিশ করবে, যাদের মধ্য থেকে সরকার একজনকে নিয়োগ দেবে।
প্রশ্ন: বিনিয়োগ কাঠামোয় কী ধরনের সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে?
উত্তর: মার্জিন লোন সীমিতকরণ, প্লেসমেন্ট শেয়ার বাতিল এবং ভালো মানের মিউচুয়াল ফান্ডে প্রণোদনা বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: আইন প্রণয়ন করলেই কি শেয়ারবাজারে সুশাসন নিশ্চিত হবে?
উত্তর: নয়। আইনের প্রয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা থাকলে তবেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব।
মো: জাহিদ/
সর্বশেষ সংবাদ